কারিগর পাখি টুনটুনি। সূঁচের মত ধারালো ঠোট দিয়ে শৈলিক বুননে টুনটুনি তৈরি করে তার নিজের বাসা। এটা যে ছোট্ট পাখি তৈরি বাসা দেখে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আসলে এর কারিগর টুনটুনিই। এই ছোট্ট পাখিকে নিয়ে কত গল্প কবিতাই না আছে। তবে আর আগের মত পাখিটি মানুষের চোখে পড়ে না। বন-জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড় কমে যাওয়ায় ক্রমশ কমে যাচ্ছে আমাদের অতিচেনা ছোট্ট এই পাখি টুনটুনি ।
কত যে নামে ডাকে টুনটুনিকে তার হিসেব করা মুশকিল। বেগুন টুনটুনি, দূর্গা টুনটুনি, মৌটুসকি, মধুচুষকি, মৌটুসি, নীল টুনটুনিসহ আরও অনেক নামে ডাকে। টুনটুনিকে গ্রামের মানুষেরা আদর করে দর্জি পাখি বলে ডাকে। পাখিদের মধ্যে বাবুই পাখিকে ‘আর্কিটেক্ট’ পাখি বলা হলেও টুনটুনির নির্মাণ শৈলী সম্পূর্ণ আলাদা। আকারে ছোট এই পাখিটিকে যতটা চালাক ভাবা হয় বাস্তবে আসলে তা নয়। এরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালবাসে।
দেখা যায় গাছের লাফা লাফি করা এই পাখিটি খুবই চঞ্চল। সারাক্ষণ ওড়াউড়ি করে দুরন্ত বালকের মতো। ওড়ার সময় পিঠের ওপরের লেজ নাড়িয়ে টুই টুই শব্দ করে উড়ে বেড়ায়। চোখে না দেখলে এই পাখির ডাক শুনে মনেই হবে না এরা আকারে এতই ছোট। এদের ডাক খুব তীব্র এবং অনেক দূর থেকে শোনা যায়। টুনটুনি এক জায়গায় কখনও স্থির থাকে না। ছোটাছুটি করে সময় কাটায়।
পাখিটি ঠোঁট দিয়ে গাছের পাতা সেলাই করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খুবই সুন্দর বাসা তৈরি করে। এরা সাধারণত ছোট-মাঝারি উঁচু গাছের পাতায় অথবা ঝোপ-ঝাড় জাতীয় গাছ যেমন লাউ, কাঠ বাদাম, সূর্যমূখী, ডুমুর, লেবু ,মেহগনি এরকম গাছের পাতায় বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। তবে টুনটুনি বেশি বাসা বাঁধতে পছন্দ করে ডুমুর গাছে। গাছের অপেক্ষাকৃত বড় যে পাতা থাকে তাতে লম্বা-গোল চৌকা আকৃতির ছাউনির মত করে বাসা তৈরি করে টুনটুনি পাখি । স্ত্রী-পুরুষ উভয় মিলে গাছের বড় ২/৩ টি পাতা দিয়ে সেলাই করে বাসা তৈরি করে । একটি বাসা তৈরি করতে একজোড়া টুনটুনি দম্পতির সময় লাগে তিন থেকে পাঁচদিন। পাখির পালক, গরু-ঘোড়ার লেজের চুল, লতা, তুলা, সুতা মিশিয়ে দৃষ্টিনন্দন বাসা বানায়। টুনটুনির বাসা বাধা ও প্রজনন মৌসুমে মাঘ মাসের শেষের দিকে ফাল্গুন মাস থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যে। বাসা তৈরি শেষ হলেই ৪/৫ টি ডিম পাড়ে টুনটুনি। স্ত্রী-পুরুষ ডিমে তা দিয়ে ১০ দিনের মধ্যে ছানা ফুটানোর পরে দশ দিনের মধ্যেই ছানাাসহ বাসা ত্যাগ করে। বছরের প্রজনন মৌসুমে টুনটুনি দম্পতি ২/৩ বার ডিম দিয়ে ছানা ফুটায়। এ সময় কেউ টুনটুনির বাসার কাছে গেলে স্বামী-স্ত্রী মিলে টুই টুই শব্দ আর ওড়া-উড়ি করে সুরক্ষা দিতে বিশেষ ভাবে চেষ্টা করে।
অনেক সময় এরা নিচু জায়গায় বাসা তৈরি করায় বন্য প্রাণির আক্রমন করে বাচ্চা বড় হওয়ার আগেই খেয়ে ফেলে। আবার পাতা গাছ থেকে ঝড়ে ডিম বা বাচ্চাসহ মাটিতে পড়ে যায়। ছোট ছেলে-মেয়েদের টুনটুনির বাসার প্রতি থাকে তীব্র আকর্ষণ থাকে তাই দুষ্টমি করে বাসা নষ্ট করে। এভাবেই কমে যাচ্ছে টুনটুনি । এখন আর আগের মত টুনটুনির টুই টুই ডাক শুনা যায়না ।
ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে পরিবেশ সুন্দর রাখে টুনটুনি। ফুলের মধুই টুনটুনির প্রিয় খাবার। ফুলে ফুলে ঘুরে পরাগয়ণেও সাহায্য করে। আম পাতার বিছা-পোকা তাদের খাদ্য তালিকায় অন্যতম। এরা যেমন চালাক তেমন বোকা।
পাঠকের মতামত: